ছেলেবেলা
ছেলেবেলা
অনেক দিন কিছু লেখা হয়নি । আসলে গত কয়েকটা মাস
দাঁতের ব্যথা বড্ড বেশি ছিল । কোন কিছুই সহজ ছিলা না । যাইহোক অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে একটু
সামাল দেওয়া গেল । আপাতত ব্যথাটা একটু কম । এর মধ্যেই অবশ্য কয়েক লাইনের একটা কবিতা
লিখেছিলাম কিন্তু গল্প লেখা হয়নি।
গত কয়েকদিন থেকে মনে হচ্ছে ছেলেবেলায় কত ঘটনা
ই তো ঘটে । সে গুলো নিয়েও অনেক মজার গল্প হয়
। তাই এই প্রচেষ্টা । আবার লিখতে বসা ।
ছোট বেলার অনেক আনন্দের স্মৃতি বিজড়িত সেই দিনগুলোকে
আমরা কেউই ভুলে যাই না ৷ ঘুরে ফিরে বারবারই আমাদের তা মনে পড়ে ৷ আমরা ফিরে যাই সোনালী
সেই দিনগুলোতে ৷ ফিরে পেতে চাই হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলিকে ৷ কিন্তু সে তো সম্ভব হয়
না । দিন এগিয়ে চলে । সময় হাড়িয়ে যায় । অতীত কে কখনো ফিরে পাওয়া যায় না । কিন্তু স্মৃতিকে
কল্পনায় নিয়ে আসা যায় । গল্পের মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে উপভোগ করা যায়। এটাও এক ফিরে
পাওয়া । হারিয়ে যাওয়া যায় আমাদের দুরন্ত শৈশবে এবং ছেলেবেলায় ৷
আমার বয়স তখন ৯ যদিও তখন ঘটা করে কারো জন্মদিন
হত না । সঠিক বয়স জানার প্রয়োজন ও ছিল না । আমার ডেট অব বার্থ প্রথম প্রয়োজন হয় জয়েন্ট
পরীক্ষার ফর্ম ভর্তি করার সময় । ঘটনাটা ভীষণ ভাবে মনে আছে কারণ ঘটনাটা আমার কাছে মোটেও
সুখের ছিলনা । জয়েন্ট পরীক্ষার ফর্ম বাবা
আনিয়ে ছিলেন আগেই । এক রবিবার ছুটির দিনে আমাকে বাবা ডাকলেন ফর্ম ভর্তি করার জন্য ।
তাঁর সামনে বসে থাকতেই আমার প্যান্ট হলুদ হয়ে যেতো তারপর ফর্ম ভর্তি করার মত কাজ করতে
হবে যেনে আমার প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মত অবস্থা । তবুও গেলাম মানে যেতেই হত । আমি দিদির
কাছে চেয়ে একটা পেন নিয়ে গেলাম তাঁর সামনে । দিদির পেন নিলাম কারণ আমি আমার পেনের উপর
ভরসা রাখতে পারিনি । বাবার সামনে যদি পেনে লেখা না পরে তবে ব্যাপারটা কি হতে পারে সেটা
আমার আগেই জানা ছিল ।
যাইহোক একটা মাদুরে দুজনে বসেছি । ফর্ম ভর্তি
করার কাজ চলছে । নিজের নাম বাবার নাম লাইন বাই লাইন এগিয়ে চলেছি । এবার এলো ডেট অব
বার্থ । আমি তো জানি না । আমার পেন আর চলে না । আমার যে কি ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল আজ
৪০ বছর পর সেটা ভাবলেই আতঙ্ক জাগে মনে । ভাবছি একবার মাকে প্রশ্ন করি কিন্তু তিনি নাগালের
বাইরে । সাধরনত এই সব সাংঘাতিক সময় গুলোতে আমার দিদিই ছিল একমাত্র ভরসা । কেন জানিনা
তখন দিদিকে বিরাট জ্ঞানী মনে হত । মনে হত দিদি সব কিছুর সমাধান করতে পারে । বিশাল নির্ভরতা
ছিল দিদির উপর । কিন্তু তার জন্য উঠে যেতে হবে। তার সাহস ছিল না । তাই চুপ করে পেনটা
ধরে বসেই থাকলাম আর প্রচণ্ড চেষ্টা চালাতে লাগলাম যদি কোন ভাবে মনে পরে আমার জন্মদিন।
হল না। কিছুক্ষণ পর বাবা বললেন “কি হল ? লেখ”। তবুও আমি বসে আছি দেখে বললেন “কি রে , জানিস না ? নিজের ডেট অব বার্থ
জানিস না”। বিরাট টানটান অবস্থা । আমি অপেক্ষা করছি কখন বাবার একটা বিশাল চড়
আমার গালে পরবে । এমন সময় দেব দূতের মত সেখানে দিদির আবির্ভাব হল । বাবা দিদি কে উদ্দেশ্য
করে বললেন “গাধাটাকে দেখ । নিজের ডেট অব বার্থ জানে না । এর দ্বারা কিছুই হবে না ।
বৃথাই চেষ্টা”। দিদি বলল “ভাই তোর এডমিটকার্ডটা নিয়ে আয় । ওটাতই আছে ডেট অব বার্থ
আর ওটাই লিখতে হবে”। আমি সামান্য সময় নষ্ট না করে উঠে গলাম ও এডমিটকার্ড টা এনে ফর্ম ভর্তি
করলাম । সে দিন প্রথম জানলাম আমার জন্মদিনটা কবে ।
সুতরাং যে বয়সটা আমি বললাম সেটা কম বেশি হতে
পারে তবে ক্লাস থ্রি এটা একদম মনে আছে । কারণ আমি যে ঘটনাটা বলবো সেটা ঐ থ্রি ছারা
সম্ভব ছিলনা ।
আমাদের ছোট্ট গ্রাম । রাড়-বাংলার পটে আঁকা সেই
গাম যার চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ ধানের ক্ষেত । গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট
একটা নদী । পার হয় যায় গরু যদিও ভরা বরষায় ঐ নদী রাক্ষসী হয়ে যেত আর আমরা তাকে উপেক্ষা
করার ছল করতাম সাঁতরে পারাপার করে । জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া ছিল এক অদ্ভুত খেলা । নদীটার
রূপ হত ভয়াবহ আর তাকে উপভোগ করাটাই ছিল খেলা । ঐ গ্রামের মানুষ গুলো ছিল ভীষণ সরল ।
জীবন ছিল ভীষণ সাদাসিধে । কোলাহল হীন উত্তেজনা হীন ছিল আমাদের ছোট্ট গ্রাম । এঁটেল
মাটির রাস্তা । অনেক আম জাম নিম আর বট গাছে ঘেরা এই গ্রাম । ছিল বেশ কয়েকটা বাঁশবন
। সারাটা গ্রামে মাথা উঁচু করে যেখানে সেখানে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে । কলা গাছের বাগান
। আর সব বাড়ির সাথে খামার ও সবজির বাগান । বিরাট আকারের ছয় সাতটা পুকুর আনাচে কানাচে
। খরের চাল দেওয়া মাটির বাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিল ঐ পুকুর গুলোর পাড়ে । ছায়া সুনিবিড় শান্তির
নীড় ছিল ঐ মাটির বাড়ি গুলো । আর ছিল বেশ কয়েকটা বিরাট তেঁতুল গাছ । ঐ তেঁতুল গাছে বাস
করতো অনেক অনেক সাদা বক । যদিও চারটে পাড়া
ছিল তবে সবাই খুব মিলে মিশে বাস করত ঐ গামে । গ্রামের শেষে একটা বিরাট খেলার মাঠ ছিল
যেখানে গ্রামের বিভিন্ন সাইজের সব ছেলে ফুটবল খেলত অনেক গুলো বল নিয়ে । কখনো ফুটবল
কখনো ক্রিকেট কখনো বা ভলিবল নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকতাম সারাটা বিকেল । এই মাঠের লাগানো
এক কোনে ছিল আমাদের প্রাইমারি স্কুল । ক্লাস ফোর পর্যন্ত গ্রামের সব ছেলে মেয়ে সেখানে
পড়তে যেত । এই স্কুলের এক পাশে ছিল ঐ বিশাল মাঠ আর অন্য পাশে ছিল এক বিশাল আমবাগান।
আম বাগানের শেষে ঐ ছোট-নদী । ঐ স্কুলে ছিল তিন জন শিক্ষক । সকলেই অন্য গ্রামের মানুষ
। একজন পড়াতেন ক্লাস ওয়ান টু । একজন থ্রি । একজন ফোর । আমি তখন থ্রিতে পড়ি । আমাদের
শিক্ষক-মশাই ছিলেন বেশ কড়া । হাতে থাকতো বেত যেটা তিনি নিজে তৈরি করতেন বাঁশগাছের ডাল
দিয়ে । আর ওটা তিনি ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে ব্যবহার করতেন । সেই মানুষটার জন্য আমাদের
প্রত্যেক দিন পাঁচটা ডিম কিনে নিয়ে যেতে হত প্রতিদিন স্কুলে । তিনি স্কুল শেষ হওয়ার
আগে একজনকে ডেকে ২৫ পয়সা দিতেন । সারাটা বিকেল সে বেচারা দোরে দোরে ঘুরে ৫টা হাঁসের
ডিম কিনত পরদিন সকালে মাস্টারমশাই কে দেওয়ার জন্য। না দিলে তার হয়ে গেল । মেয়েরা কাজটা
ভালই পারত কিন্তু মুশকিল হত ছেলেদের । ঐ ডিম কেনার ভার পরলে হয়ে গেল বিকেলটা মাটি ।
যাই হোক চলছিল এই ভাবে । প্রত্যেকদিন সকাল দশটায়
এক পেট গরম ভাত খেয়ে (মানে যতটা সম্ভব) আমরা সব দলবেঁধে স্কুলে যেতাম । স্কুলে কোন
বেঞ্চ ছিল না । ছিল চাটাই যেগুলো পেতে আমরা বসে পরতাম আর চিৎকার করে পরা তৈরি করতাম
। কেউ চিৎকার বন্ধ করলেই জুটত বেতের বারি । প্রায় ৫০ টা ছেলে মেয়ে হঠাৎ একসাথে চিৎকার
করতে শুরু করতো । এটাই ছিল প্রমাণ যে স্কুল চলছে । মাঝে মধ্যে গ্রামের মুরুব্বিরা স্কুলের
পাশে দাঁড়িয়ে শুনত আমরা যথেষ্ট চিৎকার করছি কিনা । যদি কোন গাফিলতি নজরে আসতো তালে
প্রধান শিক্ষক মশাইকে তলব করতো গাঁয়ের মোড়ল । ঘটনা চক্রে তখন গাঁয়ের মোড়ল ছিল আমার
দাদু । ঐ স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাছে ।
আমার এক প্রিয় বন্ধু ছিল । নাম ছিল সুকান্ত ।
আমরা দুজনে ছিলাম হরিহর আত্মা । শোনা যায় গ্রামের মানুষ আজও আমাদের দস্যিপনা মনে রেখেছে
। কেউ ঠিক কতটা দস্যি তার পরিমাপ বোঝাতে আজ ও আমাদের মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করে ।
একথা সত্যি আমরা ছিলাম বেপরোয়া । সুকান্ত ছিল মহা বেপরোয়া । আমাদের শোয়া বসা সব কাজ
হত একসাথে । বদমাশি করতেও নিখুঁত প্লান করতে হয় । সেটাও করতাম অতি গোপনে একসাথে । আমার
একটা সুবিধা ছিল । আমার গার্জেন ছিল কাকিমা । তিনি ছিলেন মহিলা সমিতির প্রধান । আমার
অভিযোগ কাকিমার কাছে আসতো ঠিক তবে তাতে আমার কোন বিপদ হত না । কাকিমা আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন
। বরং কেউ অভিযোগ করলে তিনি বকুনি খেতেন কাকিমার কাছে । তবে অভিযোগ দাদুর কাছে গেলে
বিচার হত । তেমন বিচার জীবনে বার তিনেক হয়েছিল গ্রামে থাকা কালীন ।
যাইহোক একদিন ডিম কেনার পালা এলো আমার কাছে ।
ভাবছি কি করা যায় । বসে ছিলাম একটা পুকুর পারে । ঐ পুকুরের পারে ছিল বিশাল এক তেঁতুল
গাছ । সেখানে বাস করতো হাজার খানেক বক । শুনেছিলাম বক ও ডিম পারে ।
আমি সুকান্তকে বললাম “এই বক গুলো নিশ্চয় ডিম
পারে”।
সুকান্ত “সে তো পরবেই”।
আমি সুকান্ত কে দেখি । সে ও আমাকে দ্যাখে । অনেক
কথা বলার প্রয়োজন হয়না যেখানে বন্ধুত্ব গভীর । তবু সুকান্ত বলে “শুনেছি তেঁতুল গাছে
সাপ থাকে”।
আমি বলি “চেষ্টা করতে ক্ষতি কি”?
যেই ভাবা সেই কাজ । আমরা হুরমুর করে গাছে উঠলাম
। আমাদের জন্য গাছে ওঠা ছিল নিত্যদিনের কাজ । বেশির ভাগ সময় আমাদের গাছেই কাটত । যা
কিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম সব গাছেই হত । গাছই ছিল সব থেকে সেফ প্লেস । কিছুটা চরেই বুঝলাম এতো স্বর্ণখনি । চারদিকে ডিমের
ছড়াছড়ি । আমাদের সে কি হাসি । ব্যাপক ব্যাপার । তখন তো হাই-ফাইব ছিলনা তবে আমরা যে
বিশাল একটা কিছু আবিষ্কার করেছি সেটা বুঝলাম । যথারীতি আমরা পাঁচটা ডিম নিয়ে নীচে এলাম
। সে এক উৎসব । পকেটে করকরে ২৫টা পয়সা । আমরা নিচে এসে অনেক বার দেখলাম ডিম গুলো ।
তারপর পুকুরে নেমে ভাল করে জলে ধুয়ে নিজের জামাতে মুছে চটের থলিতে রাখলাম । ঐ শিক্ষক
মশাই একটা ছোটো চটের থলি দিতেন ডিম কেনার জন্য । থলির গায়ে কয়েকটা পকেট ছিল । প্রতিটা
পকেটে একটা ডিম রাখার নিয়ম ছিল যাতে না ভাঙ্গে । ব্যবস্থা ছিল পাকা ।
গল্পটা শেষ । বাকিটা যা হওয়ার তাই হয়েছিল । বেশ
কয়েকবার আমরা ঐ কাজ করেছিলাম । লোভে পাপ পাপে মৃত্যু । যদিও আমি বারণ করেছিলাম কিন্তু
সুকান্ত শোনেনি । ওর বোধহয় আম্বানী হওয়ার সাধ হয়ে ছিল । ও সকলকে ডিম কিনে দেওয়ার ঠিকা
নিতে শুরু করলো । আসল ব্যাপারটা কেউ জানতোনা তবে অনুমান করতো কিছু একটা হচ্ছে । যে
ভাবেই হোক একদিন সে টা শিক্ষক মশাই এর কানে গেল । তিনি হেডস্যার কে বললেন । সেখান থেকে
মোড়ল । একদিন মোড়ল স্কুলে এলো । জানতে চাইলো ব্যাপারটা কি । সকলেই আঙ্গুল তুলে জানাল
রোজ সুকান্ত ডিম সাপ্লাই করে । সুকান্ত বলতে পারলো না সোর্সটা কি । তাকে শাস্তি পেতে
হল । কিন্তু সে একবার ও বলেনি আমার নাম । সেদিন স্কুল ছুটির পর আমরা আবার হই চই করে
একসাথে গ্রামে ফিরে এলাম।
রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার প্রিয় গান । “পুরানো সেই দিনের কথা”গানটা শুনলেই মনে পরে সেই ছোট বেলার কথা। ফিরে যায় ফেলে আসা শৈশবে ।
বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে পুকুরে স্নান বা বর্ষার
আকাশে ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলা। কালবৈশাখীর ঝড়কে মাথায় নিয়ে আম কুড়ানো । বন্ধুর সাথে গরমের দিনে কাচা আম পেড়ে খাওয়া ।বন্ধুদের
সাথে চুড়–ইভাতি । আকাশে ঘুড়ি উড়ানো বা লুকোচুরি খেলা ।
বারবার মনে হয় ফিরে যাই সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে।
কিন্তু কখন ও সে দিন ফিরে আসবে না । এটাই প্রকৃতির নিয়ম । এটাই বুঝি নস্টালজিয়া ।…………তুষার
রায়
Comments
Post a Comment