মুসা
একটা ছোটো গল্প.......
চলো , অনেক হৈ হল্লা হল । একটা সুতা কলে যা হতে পারে কয়েক মাস ধরে সব হল । অবশেষে ছুটি । এরকমই হয় । কতদিন আর চিল্লামিল্লি চলবে । সবই একদিন শান্ত হয় । মধ্যখানে আমার লেখালিখি প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো ।
অনেকদিন পর আজ সবাই শান্ত । গত কয়েক দিন অফিসের নানান ঝামেলার সাথে দাঁতে ব্যাথায় আমিও বেশ ক্লান্ত ।। সারাদিন দাঁতগুলি কিছু বলেনা । ঠিক বিছানাতে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই ব্যথা শুরু হয় । হায়রে আমার কপাল ।
যাই হোক গভীর বিষয় নিয়ে কিছু লেখা মুস্কিল এখন । আবার লিখতে চাইছে মন তাই ঠিক করলাম আমার নিস্তরঙ্গ জীবনেও কিছু তরঙ্গ আসে মাঝে মাঝে তাই নিয়েই যা দেখি তাই লিখবো ।
আজকের গল্পটা কিন্তু হাসির নয় যদিও ঘটনাটা যখন ঘটছিল তখন আমার ও হাসি পাচ্ছিল কিন্তু পরবর্তী কালে ব্যাপারটা আর হাসির ছিল না ও আমার মনকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছিল ।
আমি একটা সুতা কলের ম্যানেজার হলেও আমার সাথে যারা কাজকরে আমি তাদের বহুদিন ধরে চিনি । প্রায় সকলের নাড়িনক্ষত্র আমার জানা । সকলেই পুরুষ । আমি মেয়েদের কাজ দিই না । এখন প্রায় ২৭০ জন পুরুষ এবং সকলের সাথে আমার সম্পর্ক মধুর না হলেও অমধুর নয় যদিও আমি রেগে গেলে এরা ভয় পাই । ঠিক কেন জানিনা কিন্তু পায় । এনিয়েও অনেক গল্প আছে যেটা পরে লেখা যাবে। আজকের গল্পটা ভণিতা না করলে এভাবে বলা যাই আমার এক মেকানিকের নাম মুসা । একটা বিভাগের হেড মেকানিক । ওকে আমি নিয়ে এসেছিলাম অন্য এক শহরের অন্য একটা মিল থেকে । লেগসে তার থাকার যায়গাও আমিই করে দিয়েছিলাম একে ওকে ধরে । তার বৌ নাই । বেশ কয়েকটি ছেলে মেয়ে । বয়স প্রায় ৪০ কিতার একটু বেশি । বড় মেয়ে । তাকে নিয়ে ওর চিন্তা ছিল । লেগসে আসার পর ছেলে মেয়েকে অন্য শহরে রেখে ঐ মেয়ের জন্য উতলা ছিল মুসা । সে প্রায় বছর চারক আগের কথা । এরপর মুসার ছেলেমেয়ে লেগসে চলে এলো । মুসা শান্তশিস্ঠ মানুষ । প্রায় ২০ বছর ধরে সুতা কলে মেকানিক । ভাল কাজ জানে । মাঝে মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে লোণ চাইতে আমার কাছে এসেছে । কখনো কোনও অসুবিধার কাড়ন হয়নি সে ।
হঠাৎ একদিন মুসা এল আমার কাছে । বলি ব্যাপার কি ? সে খুব আস্তে ও সম্ভ্রম নিয়ে যা বলল তার অর্থ ওর রড় মেয়ে নিরুদ্দেশ । আমি আঁতকে উঠি বলিসকি রে । আমি বলি পুলিশ কে জানা । আমি লেগস খুব ভাল চিনি । দুর্ভাগ্য বসতো আমার ছেলেরা বেশিরভাগই কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন অপরাধ জগতে যাওয়া আসা করে । ওদের মাধ্যমে আমাকে না চাইলেও যতটা জানতে হয় তাতে লেগস শহরটার অন্য একটা রূপ আমার জানা । আমার কিছু পরিষদ আছে । এই ধরনের সমস্যায় আমি তাদের ডাকি । আমি মুসাকে বললাম সে ঠিক কি সাহায্য আশা করছে। সে বলল গত দুদিন হল মেয়ের খোঁজ নাই । সে বিশেষ কাউকে জানেনা । মিলে কয়েকজন কে বলেছ তবে সবাই বলে “চলে আসবে অপেক্ষা কর” । মেয়ের বাবার মন । তাই আমার কাছে উদ্দেশ্য হিন ভাবেই এসে পরেছে ।………
মেয়ের বাবার মন । তাই আমার কাছে উদ্দেশ্য হীন ভাবেই এসে
পরেছে । আমি ওকে প্রশ্ন করলাম “মেয়ের বয়স কত
?” সে জানালো ১৬ । আমি জানতে চাইলাম কোনও ঝগড়া হয়েছিল কি না বা তার কোনও ছেলে বন্ধু
ছিল কিনা । সে জানালো কোন ঝগড়া হয়নি ও মেয়ে খুব শান্ত । ছেলে বন্ধুর ব্যাপারে কিছু
শোনেনি । আমি ওকে বললাম একঘণ্টা পর আসতে । তারপর এক সাগরেদ কে ডাকলাম । সে গত ২০ বছর
ধরে আমার দেহরক্ষীর শুধু নয় একটা শিফটের প্রোডাকশন ম্যানেজার । কাজ কি করে বলা মুশকিল
তবে সবাই ওকে সমীহ করে কাড়ন সে একজন ক্রিমিনাল । যত বদকাজ সবই তার আয়ত্তে তবে ওগুলো
বদকাজ বলে সে মনে করে না কখনো । দুটো বৌ আইনগত ভাবে । তার বৌদের ইতিহাস হয়তো কখনো শোনাবো
। যাই হোক সেও এক অদ্ভুত চরিত্র । তাকে ডেকে কথাটা জানাতে সে একটু সময় চাইলো ও চলে
গেল । ৩০ মিনিট পর একটা ২০ -২২ বছরের ছেলেকে নিয়ে এলো তার নাম ঈশাইয়া । সে জানালো ডেভিড
লুকা মুসার ভাইপো । আমার মনে পড়লো মুসা একবার একটা সুপারিশ নিয়ে এসেছিল কাজের জন্য
। এ সেই ডেভিড । মুসার মেয়ে ডেভিডের কাছে আছে । আজকাল ডেভিড খুব বড় মস্তান (এরিয়া বয়)হয়েছে
। সকলকে ভয় দেখায় ।
আমি ও আমার সাগরেদ, মুসাকে ডাকলাম ও জানালাম ডেভিডের
কথা । সে তো বিশ্বাস করতে চাইনা । একই পরিবারের মানুষ ওরা । এটা হয়না । সে বলল “এটা
হতেই পারেনা” । আমি
বললাম “একবার ডেভিডের সাথে কথা বল”। যাইহোক
সেদিনের মত মুসা চলে গেল কিন্তু আমার মনে হল এই ডেভিড বাবাজির একটু খোঁজ নেওয়া ভাল
।
সর্বপ্রথম তার প্রিয় বন্ধুদের খোঁজ পড়লো । তার সাথে বালকের
হালহকিকত জানার ব্যবস্থা হল । তার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানা গেল তার আস্তানার খবর । জানলাম
সে ২টো নাগাদ ডিউটিতে আসবে । ঠিকহল আমার ড্রাইভার , আমার সাগরেদ ও একজন তদন্তে যাবে
। আমার মন বলছিল মেয়েটি ওখানে ই আছে ।
২টো নাগাদ ডেভিড কাজ শুরু করলে আমি সিকিউরিটি অফিসারকে
বললাম যেন ডেভিড মিলের বাইরে না যাই ।
তিনটে নাগাদ ফোনে জানলাম মেয়েটি সশরীরে সেখানে আছে এবং সে লুকিয়ে নেই । স-ইচ্ছাতেই
আছে । আমি আমার সাগরেদকে বললাম ওখানে থাকতে ।
মুসা কে জানানো হল । সে তো হতবাক । আমি ব্যাপারটা পারসোনাল
ম্যানেজারের হাতে দিলাম ও বললাম ডেভিডকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে । এটাও বললাম যদি স্বীকার
করে ভাল অন্যথায় আমাকে তাড়াতাড়ি জানাতে ।
অল্পকিছু সময় পরে মুসা ও ঐ ভদ্রলোক ফিরে এসে জানালো ডেভিড
স্বীকার তো করেনি আবার মুসাকে অন্যায় ভাবে অপমানও করেছে ।
দেরি না করে কাছের থানায় ফোন করে পুলিস ডাকা হল ।সব শুনে
পুলিস মুসা ,ডেভিড ও আমাদের পারসোনাল ম্যানেজারটিকে নিয়ে মুসার মেয়ে উদ্ধারে বেরিয়ে
পড়লো । আমি আমার সাগরেদ জানিয়ে দিলাম ।
প্রায় ১ঘন্টা পর মুসা মেয়েকে ফিরে পেলো । ডেভিড বেচারা
থানায় জমা পড়লো । আমার সাগরেদ ও পারসোনাল ম্যানেজার বীর দর্পে ফিরে এসে আমাকে তার জয়লাভের
ইতিকথা শোনালো । কিছু টাকা পুলিশকে বকশিশ দিয়ে বল্লাম ছোকরাকে প্রতিদিন দশবেত মারতে
। ………এখানে কিন্তু শেষ
নয় ।
ডেভিডকে এক সপ্তাহের জেল হাজতে পাঠানো হল । পুলিসকে বলা
ছিল কোর্টে না তুলতে । এক সপ্তাহের ছুটি ডেভিডের বাৎসরিক ছুটি থেকে কেটে নেওয়া হল ।
কিন্তু পুলিস ওকে আর ছাড়েনা । খবর নিয়ে জানলাম তারা ডেভিডের কাছে টাকা চাইছে । ১০০০০টাকা
লোণ দেওয়া হল । ডেভিড ছাড়াপেল । আমি ভাবলাম যাক মিটল । ডেভিডের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে
। আর সে এ পথে যাবেনা । ব্যাপারটা এখানে শেষ হলে আমি খুব খুশি হতাম কিন্তু তা হল না
।
বেশ কিছুদিন পর একদিন বিকেলে পার্সোনাল ম্যানেজার আমাকে
জানালো মুসা লেগস ছেড়ে গ্রামে চলে যাবে । ইস্তফা দিতে এসেছিল ।
আমার মাথায় হাত । এতো মুস্কিল ব্যাপার । আমি কারণ জানতে
চাইলে ঐ ম্যানেজারটি জানালো মুসার মেয়ে আবার ডেভিডের বাড়িতে । আমি ভাবি এতো বড্ড মুস্কিল
। এই সমস্যার সমাধান তো জানিনা । আমি ডেভিড কে কারখানা থেকে বার করে দিতে পারি কিন্তু
তাতে সমস্যার সমাধান তো হবে না । মুসা কে আমাদের চাই । খুব চিন্তায় পরলাম । কেউ কোনও
উপায় বলতে পারল না । আমার ছেলে মেয়ের জন্য কখনো আমাকে এই সমস্যায় পরতে হয়নি । আসলে
এই ধরনের সমস্যা আমার জীবনে প্রথম ।
আমি ঠিক কয়েকদিন সময় চাইলাম ও পার্সোনাল ম্যানেজারকে
বললাম মুসাকে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বলো ও এটাও বললাম সে কোনও ভাবে যেন তার মেয়ের সাথে
দেখা না করে ও এ ব্যাপারে কারো সাথে কথা না বলে ।
আমার ব্যাপারটা খুব আশ্চর্য রকম লাগলো এবং মনে হল এমন
কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে যেটা আমি জানি না । আমি পার্সোনাল ম্যানেজারকে বললাম সে ডেভিড
ও মুসার মেয়েকে যেন ডাকে । শনিবার আমি কথা বলতে চাই । আমার মনে হচ্ছিল এই জট খুলতে
গেলে ওদর সাথে কথা বলা প্রয়োজন ।
যথারীতি শনিবার দুপুর ১টায় মেয়েটি হাজির । সারা মিল জুরে
২৫টা ক্যামেরা লাগানো । আমি মেয়েটিকে দেখলাম । ছোট্ট মেয়ে কিন্তু বেশ সেজে গুজে এসেছে
। জিনস ও টিশার্ট পরছে । পায়ে হিল স্লিপার । আবার মাথায় ওড়না দেওয়া । বেশ স্মার্ট মনে
হল । আমি পার্সোনাল ম্যানেজারকে তার আগমন বার্ত্ত
দিলাম ও তাকে যত্নকরে বসাতে বললাম । তাকে এক টা কোক দিতেও বললাম । পার্সোনাল ম্যানেজারকে
বললাম তাকে ৩০মিনিট পর আমার কাছে নিয়ে আসতে ।
আমি এটাও বললাম মুসা ও ডেভিড যেন আমার সাথে দেখা করে
। সময় হলে তাদের ডাকা হবে । শনিবার কাজের চাপ কম । দুটোর মধ্যে ছুটি হয় ।
মেয়েটিকে নিয়ে এলে আমি বসতে বললাম ও দেখলাম । ওকে দেখে
মুসার মেয়ে মনে হলনা । সুতা কলের শ্রমিকের অবস্থা পৃথিবী জুরে একই । চীন , পাকিস্তান
, ভারতবর্ষ ও নাইজেরিয়া সব দেশে সবথেকে গরীব মানুষ এই সুতা কলের শ্রমিক । মেয়েটির পোশাক
বেশ দামি মনে হল । বিশেষ করে পারফিউম বেশ দামি । মিনিট দশেক দেখার সময় তার নাম ও শিক্ষা
কতদূর জানলাম । তাদের দেশ কোথায় ও সেখানে কে থাকে এই সব খেজুরে আলাপ হল । এই সময় আমি
বিশেষ ভাবে দেখলাম তার কথা বলার ধরন । সত্যি মেয়েটি নিজেকে অনেক খেটে তৈরি করেছে ।
হঠাৎ করে প্রশ্ন করলাম “তুমি ডেভিডের ঘরে থাকো ?”
সে স্থির ভাবে উত্তর দিলো “হ্যাঁ”।
আমি বললাম “ডেভিড কে হয় তোমার” ।
সে বলল “ভাই”।
আমি বললাম “রিয়েল ভাই”।
সে বলল “কাকার ছেলে । একই পরিবার”।
বললাম “তুমি কি কাজ করো”।
সে জানালো একটা বিয়ার বারএ কাজকরে । বলে রাখা ভালো বিয়ার
বার কোনো অসামাজিক স্থান নয় । এখানে সকলেই যায় । খোলা আকাশের নিচে আধো আলোতে বন্ধুরা
মিলে এখানে বিয়র ও ঝলসানো মাংস বা মাছ খাওয়ার রেওয়াজ লেগসে বহুকালের । আরো জানলাম প্রতি
সন্ধ্যায় মোটামুটি ১০০০টাকা ইনকাম হয় তার । কখনো বা বেশিও হয় । সে আরও জানালো তার বাবার
বাড়িতে থাকা ও ভাই বোন দের দেখাশোনা করতে তার ভাল লাগে না । সে পড়াশোনা করতে চাই ও
কাজ করতে চাই । তার বাবা গরীব । সকলে ভালকরে খেতেও পায় না । সে ওভাবে বাঁচতে চাইনা
। তাই সে বিয়ার বারে কাজ করে ও ভাই –এর কাছে থাকে । এ আমার রুপালীর ঠিক উল্ট চরিত্র
। তার ভাই ও তার বন্ধুরা খুব ভালোবাসে তাকে । সে ভাল আছে । সে পড়াশোনা করতে চাই ভবিষ্যতে ।
এর পর আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করিনি । বললাম ভালভাবে থাকতে
। যদি কখনো প্রয়োজন হয় আমার কাছে আসতে । তাকে নিচে পার্সোনাল ম্যানেজার এর ঘরে বসতে
বললাম ও ডেভিড কে ডাকলাম । প্রথমই বললাম তুই আবার কেন ওকে নিয়ে গেছিস । সে বলল “ও নিজেই
এসেছে”। আমি বললাম “ওকে তুই বিয়ে করবি”? সে বলল “না”। আমি বললাম “কেন”। সে বলল “শী ইজ মাই সিসটার”।
ঠিক এর পর আমার প্রশ্ন করার কিছু ছিলনা । আমি ওকে বললাম
“তুই ওকে দেখাশোনা করতে পারবি” ।
সে বলল “শী টেক কেয়ার হারসেল্ফ”। আমি বললাম “তোর বন্ধুরা ওকে বিরক্ত করবে” । সে বলল ও থাকলে বন্ধুরা আসেনা । তাছাড়ার তারাও ওর
বন্ধু । আমি ওকে নিচে যেতে বলে মুসাকে ডেকে বললাম “তোমার মেয়ে ভাল আছে” । আমি তকে বললাম “মেয়েকে ডেভিডের কাছেই রাখতে” । চিন্তার কিছু নাই ।
সে চলে গেল । মেয়েটি ডেভিডে সাথে চলে গেল । আমার কাছে
শুধু অনুভূতিটা থেকে গেল । কিছু বুঝলাম তবে বেশিটাই না বোঝা হয়ে থাকলো । তবে মেয়েটি
কে আমার মোটেও রহস্যময়ী মনে হয়নি বরং সৎ ও
সাহসী মনে হল যদিও তাকে ঠিক বুঝতেও পরলাম না । এটাই হয়তো GENERATION GAP ।
Comments
Post a Comment